খুলনা, বাংলাদেশ | ১৩ মাঘ, ১৪৩১ | ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত

আইএমএফের চতুর্থ কিস্তি ছাড়ে জটিলতা, অর্থনীতিতে চাপ বাড়বে

গেজেট ডেস্ক

নির্ধারিত সময়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পর্ষদ সভা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় পিছিয়েছে বাংলাদেশের ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তি। এ নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

তবে বাংলাদেশে ব্যাংক ও সরকার আশাবাদী- পর্ষদ যখনই হোক ঋণের চতুর্থ কিস্তি পেতে সমস্যা হবে না। তারপরও টানা চতুর্থবার রাজস্ব লক্ষমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হওয়ার কারণে কিছুটা শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

আগের কিস্তিগুলো পেতে বাংলাদেশকে রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতার জন্য ছাড়ের আবেদন করতে হয়েছে। এবার অবশ্য রিজার্ভ সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। তবে এতদিন রাজস্ব ঘাটতির বিষয়টি স্টাফ পর্যায়ে সমাধান হলেও এবার এটি বোর্ডে উঠছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, মূলত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের শর্ত প্রতিপালন নিয়ে দরকষাকষির কারণেই চতুর্থ কিস্তি পিছিয়ে যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করেন, এমন ধারণা বাস্তবসম্মত নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, ‘আইএমএফ বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রাকৃতিক দুর্যেোগের কারণে তারা বোর্ড সভা পিছিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের ঋণের শর্ত পরিপালন না হওয়ায় বোর্ড সভা পিছিয়ে যাচ্ছে কিংবা শর্ত পালন না হওয়ার কারণে ঋণ ছাড়ে দেরি হচ্ছে এমন ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। আমরা আশাবাদী বোর্ড চতুর্থ কিস্তি অনুমোদন করবে। কারণ বিগত দিনে কাঙ্ক্ষিত রিজার্ভ সংরক্ষণ না হলেও কিস্তি ছাড় হয়েছে।’

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অপর একটি সূত্র বলছে, রাজস্ব আহরণ এবং নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে কিছুটা জটিলতা দেখা দিয়েছে। আইএমএফ চাচ্ছে, কর আদায় ও নীতি গ্রহণ সংস্থাকে আলাদা করতে। বাংলাদেশ সরকার সেটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তবে এর কারণে কিস্তি ছাড় হবে না এমনটা বলার সুযোগ নেই।

তাছাড়া যদি বাংলাদেশের ঋণের বিষয়টি এজেন্ডাভুক্ত হওয়ার পর বাদ পড়তো তাহলে এমনটি বলা যেত। যেহেতু এখনও এজেন্ডায় রয়েছে তাই আশা হারানোর সুযোগ থাকছে না। তবে এবারই প্রথম রাজস্বের বিষয়ে ছাড় পেতে বোর্ডে আবেদন যাচ্ছে। বোর্ড বিষয়টি কিভাবে গ্রহণ করবে সেটি নিয়ে কিছুটা সংশয় থাকছে। যেহেতু ঋণ কর্মসূচির অঙ্ক বাড়নোর একটি নতুন প্রস্তাব উঠছে, এমন পরিস্থিতিতে সেটি অনুমোদন হবে কিনা তা নিয়ে ভয়ের কারণ থাকতেই পারে।

এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর আইএমএফ মিশন প্রধান সংস্থাটির গবেষণা বিভাগের ডেভেলপমেন্ট ম্যাক্রোইকোনমিকসের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও অর্থ মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, চতুর্থ কিস্তির ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার ছাড়ে তারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। একই সঙ্গে তিনি জানান, চলমান কর্মসূচির আওতায় ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে ৫৩০ কোটি করতেও তারা সম্মত।

৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি থেকে বাংলাদেশের এখন চতুর্থ কিস্তির অর্থ পাওয়ার কথা। আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি সংস্থাটির যে পর্ষদ বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, তা যুক্তরাষ্ট্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আগামী ১২ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে। তুষারপাতের কারণে আইএমএফসহ অনেক প্রতিষ্ঠান প্রায় এক মাস বন্ধ থাকায় বৈঠক পিছিয়েছে বলে অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘আইএমএফের পরের কিস্তি পাবে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রে এ বছর তুষারপাত এত বেশি হয়েছিল যে আইএমএফের অফিসই বন্ধ ছিল। তাই সংস্থাটি পর্ষদ বৈঠক পিছিয়ে মার্চে নিয়েছে।’

দেশে মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) হার বৃদ্ধি পাওয়া বা কমার সঙ্গে আইএমএফের পরের কিস্তি পাওয়া না-পাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই বলে মনে করেন গভর্নর।

অর্থ বিভাগের সূত্রগুলোও বলছে, পরের কিস্তি পাওয়ার আগে যেসব শর্ত পূরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেগুলো পূরণ করছে বাংলাদেশ। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য বহুমাত্রিক কৌশল অবলম্বন করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশকে প্রতিটি কিস্তি পেতে কিছু শর্ত পরিপালন করতে হচ্ছে। চতুর্থ কিস্তির জন্য গত জুনভিত্তিক দেওয়া বিভিন্ন শর্তের মধ্যে কর সংগ্রহ ছাড়া সব শর্ত পূরণ হয়েছে। চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি দেখতে গত ৩ ডিসেম্বর ঢাকা সফরে আসে আইএমএফের ১৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল। প্রতিনিধি দলের বৈঠকে বার বারই কর আহরণ বাড়ানোর বিষয়টি অনেক গুরুত্ব পায় বলে জানান অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। তিনি আরও জানান, শুধু চতুর্থ কিস্তির জন্য নয়, আগের কিস্তিগুলোতেও কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়নি।

সূত্র জানায়, আইএমএফ প্রতিনিধি দল কর অব্যাহতি সুবিধা কমিয়ে রাজস্ব বাড়ানোর জন্য চাপ দেয়। একইসঙ্গে কর-জিডিপি অনুপাত বছরে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধির সঙ্গে নতুন করে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। সরকার এ শর্ত নিয়ে দরকষাকষি করে। বাড়তি রাজস্ব আহরণের কৌশল হিসেবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেই অর্থবছরের মাঝপথে এসে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ায় সরকার। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। নানা মহল থেকে সমালোচনা শুরু হয়।

এমন পরিস্থিতিতে ওষুধ, মোবাইল ফোন সেবা, রেস্তোরাঁ, পোশাক, মিষ্টিসহ কয়েকটি পণ্য ও সেবায় বাড়তি শুল্ক-কর কমায় সরকার। এতে করে বাড়তি রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আইএমএফের স্থানীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তারা অর্থ মন্ত্রণালয়, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে রাজস্ব বাড়ানোর অন্যান্য উদ্যোগের পাশাপাশি দ্রুত কর আদায় ও নীতি গ্রহণ সংস্থাকে আলাদা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি থেকে সাত কিস্তিতে আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশের ৪৭০ কোটি ডলারের একটি ঋণ কর্মসূচি চলমান। এর দুদিন পরই ঋণের প্রথম কিস্তিতে ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে আসে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তিতে ছাড় হয় ১১৫ কোটি ডলার।

তিন কিস্তিতে আইএমএফের কাছ থেকে প্রায় ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিশ্রুত ঋণের মধ্যে আর বাকি আছে ২৩৯ কোটি ডলার। এ দফায়, অর্থাৎ চতুর্থ কিস্তিতে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। বাকিগুলো পাওয়া যাবে ২০২৬ সাল নাগাদ আরও তিন কিস্তিতে।

বাংলাদেশ অবশ্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির সঙ্গে একটি আলাদা প্যাকেজে সংস্থাটি থেকে আরও ৭৫ কোটি ডলার বাড়তি চেয়েছে। এর বিপরীতে আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে, বাংলাদেশ সেগুলোও পূরণের পথে রয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রসঙ্গত, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৫ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে এনবিআর। এ সময়ে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা; আদায় হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। এ হিসাবে ঘটতি রয়েছে ৫৭ হাজার ৭০১ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪২ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে ছিল এনবিআর।

গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আদায় হয়েছিল প্রায় এক লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। এ হিসাবে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় এক হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। এনবিআরের সংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য জানিয়েছেন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। তবে তা আদায় করতে না পারায় সংশোধিত বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা ২২ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছিল।

 

খুলনা গেজেট/এইচ




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!